Sunday, July 23, 2017

সাবধান! ভয়ংকর প্রতারনার পর অশালীন ভিডিও দিয়ে কোটি টাকার ব্লাকমেইল!

একটি নামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহ্‌ মো. মুজাহিদ। রাজধানীর অভিজাত পরিবারের গৃহশিক্ষক ছিল। এই সুযোগে ওই পরিবারের গৃহবধূকেই ধর্ষণ করে।
তবে শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি সে। ঘটনার ভিডিওচিত্র ধারণ করেছে। নিজেই মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে ধর্ষিতার স্বামীর কাছে। সেই মেসেজে লিখা ছিলো, ‘ভাই, আমি ভাবিকে বিদেশি ওষুধ খাইয়ে সেক্স করেছি। তিন ঘণ্টা ধরে সেক্স করেছি। দ্রুত ডাক্তার দেখাবেন। না হলে তার কিডনি ড্যামেজ হয়ে যাবে’।
জানা গেছে, শাহ মো. মুজাহিদ নামের ওই যুবককে গত বছর আগস্টে নিজের দুই সন্তানের জন্য গৃহশিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন রাজধানীর ভাটারা এলাকার ব্যবসায়ী মামুন। অনেকটা নিজ সন্তানের মতো মনে করে ওই গৃহশিক্ষককে নিজ ফ্ল্যাটেই থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি। পরিবারের অন্য সদস্যদের মতোই অবস্থান ছিল মুজাহিদের। তবে মুজাহিদের চোখ পড়ে মামুনের অর্থবিত্তের দিকে।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গৃহকর্ত্রীর সরলতার সুযোগে কোমল পানীয়ের সঙ্গে নেশাজাতীয় যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট খাইয়ে গৃহকর্ত্রীকে তিনি ধর্ষণ করেন। গৃহকর্তা মামুন অসুস্থতার কারণে ওই সময় এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর গৃহকর্তা মামুনকে অশ্লীল ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে এক কোটি টাকা দাবি করেন মুজাহিদ। বিষয়টি পুলিশ কিংবা র‌্যাবকে অবহিত করলে পরিণাম আরও খারাপ হবে বলে হুমকি দেন তিনি।
পরবর্তীতে সেটা বিশ্বাস করানোর জন্য আরো একটি মেসেজ পাঠিয়েছিল ওই গৃহশিক্ষক। তাতে লিখা- আপনার বাসার দারোয়ানের বেডের নিচেই একটি কালো রংয়ের পেনড্রাইভ রেখে আসছি। সেই পেনড্রাইভে ধর্ষণের ভিডিও আছে। পরে সেখান থেকে নির্যাতিতার স্বজনরা পেনড্রাইভটি সংগ্রহ করেন। সেই ভিডিও দেখে তারা আঁতকে ওঠেন। এরপরও মান-সম্মানের কথা ভেবে বিষয়টি চেপে যান তারাএমনকি বিশ্বাস করানোর জন্য পেনড্রাইভে করে তা পাঠিয়ে দিয়েছে কৌশলে। ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য দেখে আঁতকে ওঠেন স্বজনরা। এরপর ফের ঐ গৃহকর্তাকে এস এম এস করে বলেন, আমার বসেরা বলছে, ওই ভিডিও দিয়ে ব্লু-ফিল্ম তৈরি করতে। এখন আপনার টাকার ওপর সব নির্ভর করবে।’ গত বছর ৬ নভেম্বর ওপরের দুটি খুদেবার্তার বাইরেও অভিযুক্ত শাহ মো. মুজাহিদ অন্তত ১২টি খুদেবার্তা পাঠিয়েছিলেন ভুক্তভোগী । এ ঘটনায় ১১ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানায় পর্নোগ্রাফি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলায় (নম্বর-৮)।
এরপর ধর্ষক মুজাহিদ ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করতে চেষ্টা করে পরিবারটিকে । বিশাল চক্রের মাধ্যমে দাবি করে কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগে মাস্টার্স পাস করা মুজাহিদ ৩৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মামলার বাদী ব্যবসায়ী মামুন জানিয়েছেন , খোকন নামে এক ব্যক্তি গৃহশিক্ষক হিসেবে মুজাহিদের তথ্য দিয়েছিলেন। মুজাহিদ তখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করতেন। গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার নরপতি শ্রীকুটা ফকিরবাড়ী।
পরে এ ব্যাপারে ২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ধর্ষিতার স্বামী। গৃহকর্ত্রীর স্বামী ও মামলার বাদী মামুন বলেন, একপর্যায়ে ভাটারা থানা পুলিশের দ্বারস্থ হন তিনি। চলতি বছর ১১ জানুয়ারি ভাটারা থানায় শাহ মো. মুজাহিদ, শাহ মো. মুশাহিদ ও মো. জুবায়েরকে আসামি করে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করলে পুলিশ প্রথম দুই আসামিকে গ্রেফতার করে। পুলিশ মুজাহিদের মোবাইল থেকে এসব ভিডিও উদ্ধার করে। এরমধ্যে মুজাহিদ জামিনে বেরিয়ে আসে।
ভুক্তভোগি পরিবারটির অভিযোগ, জামিনে বেরুবার পর ওই মামলা তুলে নিতেও হুমকি অব্যাহত রেখেছে মুজাহিদ গ্যাং। এ ব্যাপারে বাদী ভাটারা থানায় গত ২০শে জুন আরও একটি মামলাও দায়ের করেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, গত ১৮ই জুন তার মোবাইলে ফোন করে মামলা তুলে না নিলে জীবনে শেষ করে দেয়ার জন্য হুমকি দেয়। বাদী উল্লেখ করেন এই অবস্থায় তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু ওই গৃহবধূই নয়, একাধিক নারীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের ব্লাকমেইল করেছে এই যুবক। এদিকে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন গাড়িচালক হাসান উল্লাহ। গত ২৫শে এপ্রিল সাক্ষী হিসেবে আদালত তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এতে তিনি ওই দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেন। এছাড়া ১৬১ ধারায় ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন গৃহবধূ নিজেও।
ড্রাইভার তার জবানবন্দিতে বলেন, ওইদিন তিনি ডিউটি করার জন্য যান। সাহেব (ভিকটিমের স্বামী) তখন হাসপাতালে ছিলেন। বিকাল ৪টার দিকে লজিং মাস্টার মুজাহিদ সাহেবের ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাসার নিচেই পার্কিংয়ে আসে। মুজাহিদ গাড়ি বের করতে বলে। সে (মুজাহিদ) জানায়, বাচ্চাদের নিয়ে তিনশ’ ফিট রাস্তার দিকে বেড়াতে যাবে। জবানবন্দিতে ড্রাইভার বলেন, তিনশ’ ফিট রাস্তার দিকে যখন যাচ্ছিলাম তখন দু’জন ব্যক্তি গাড়ি থামানোর জন্য সিগন্যাল দিলে মুজাহিদ আমাকে গাড়ি থামাতে বলে। মুজাহিদ ও নজরুল তাদের ভাই সম্বোধন করে গাড়িতে উঠতে বললে তারা গাড়িতে ওঠে। আমরা ইসাপুরার দিকে যাই। ইসাপুর লোকশূন্য এলাকা। ইসাপুরায় গিয়ে দেখি, ৫-৬ জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। মুজাহিদ আমাকে সেখানে থামতে বলে। আমি দাঁড়ালে লোকগুলো দৌড়ে আসে। তারা আমাকে ও বাচ্চাদের জিম্মি করে। মুজাহিদ, ওয়ালিদ, নজরুল সেখান থেকে চলে যায়। আনুমানিক ২ ঘণ্টা পর জিম্মিকারীদের একজনের কাছে একটা ফোন কল আসে। তারা বলে, বস কাজ ওকে। তাদের কি ছেড়ে দেবো?
ড্রাইভার জানান, এরপর তারা আমাদের ছেড়ে দিলে জলদি বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় চলে আসি। বাসায় এসে দেখি ম্যাডাম কাঁদছে। আমি ম্যাডামকে জিম্মি হওয়ার কথা জানাই। ম্যাডাম আরো কান্নাকাটি করে। আমি সাহেবের বাচ্চাদের বাসায় রেখে এবং গাড়ির চাবি দিয়ে বাসায় চলে যাই। পরে স্যারকে বিষয়টি অবগত করি।
ওইদিনে গৃহবধূর সঙ্গে ধর্ষক গৃহশিক্ষক যে ঘটনা ঘটিয়েছে তারও জবানবন্দি রেকর্ড করেছেন আদালত। ১৬১ ধারায় দেয়া নির্যাতিতা ওই গৃহবধূ জানান, মুজাহিদ আমার ছেলে-মেয়েকে পড়াতো। ঘটনার দিন আমার স্বামী এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ওইদিন মুজাহিদ আমার ছেলে-মেয়ে এবং ড্রাইভার হাসানকে নিয়ে তিনশ’ ফিট রোডে ঘুরতে যায়। যাওয়ার ৪০-৪৫ মিনিট পর মুজাহিদ বাসায় একা ফিরে আসে। তখন তার হাতে একটি কোল্ড ড্রিংকস ছিল। এটা আমার হাতে দিয়ে খেতে বললে সেটা খাই। খাওয়ার পর মাতালের মতো হয়ে যাই। তখন মুজাহিদ আমাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে এবং মোবাইলে ভিডিও করে। সেটা দেখিয়ে আমাকে বলে যে, টাকা না দিলে আমার ছেলে- মেয়েকে ছাড়বে না এবং ভিডিও স্বামীকে দেখানোর হুমকি দেয়।
জবানবন্দিতে ভিকটিম বলেন, আমি মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে লকারের চাবি দিয়ে দিই। পরে মুজাহিদ লকার থেকে টাকা, ৫টি চেক নিয়ে নেয় যাতে আমাকে স্বাক্ষর করায়। তার কাছে থাকা তিনটি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়। সে জানায়, আমি যদি আরো টাকা না দিই, তাহলে ভিডিও আমার স্বামীকে দেখিয়ে দেবে। এ ঘটনা স্বামীকে বলে দিই। ঘটনা শোনার পর আমার স্বামী মুজাহিদকে ফোন করে। মুজাহিদ আমার স্বামীকে বলে, যদি তাকে এক কোটি টাকা না দেয়া হয় তাহলে তার স্ত্রীর নগ্ন ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবে।
  • গৃহবধূ বলেন, আমার স্বামী মুশাহিদ ও জুবায়েরের নিকট আপসের জন্য ফোন করে। ওরাও আমার স্বামীকে ব্লাকমেইল করতে চেষ্টা করে। এরপর আমার স্বামী কোনো উপায় না পেয়ে থানায় গিয়ে মামলা করে। ভিকটিমের এই জবানবন্দি রেকর্ড করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রণব কুমার হুই।
গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, মামলার তদন্তে একজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তিনি জানান, তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, আসামি মুজাহিদ একটি পর্নোগ্রাফি গ্যাংয়ের সদস্য। এর আগেও এই গ্রুপের সদস্যরা অনেক নারীর সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেইল করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে। অশ্লীল এসব দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করে পর্নো ছবিও তৈরি করেছে তারা। এই গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য তার সহোদর মুশাহিদ।
গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই পুলিশের কাছে এসব স্বীকার করেছেন মুজাহিদ। তিন দফায় আট দিনের রিমান্ডে আদায় করা তথ্যের ভিত্তিতে মুজাহিদের গ্রামের বাড়ি থেকে একটি মুঠোফোন, একটি পেনড্রাইভ ও একটি মেমোরি কার্ড উদ্ধার করেছে পুলিশ। মেমোরি কার্ডে অপর একজন নারীর সঙ্গে অভিযুক্ত মুজাহিদের সেক্স ভিডিও পাওয়া গেছে। উদ্ধার আলামতগুলো এরই মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ফরেনসিক ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষার প্রতিবেদনেও ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে।

No comments:

Post a Comment