Thursday, May 25, 2017

কারাগারে ধর্ষণ মামলার আসামি সাফাত-নাঈমের মারামারি


রাজধানীর বনানী রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের মামলার প্রধান দুই আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফ কারাগারে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নাঈম আশরাফকে কারাগারে নিয়ে আসা হয়।
এরপর সারারাত অনান্য হাজতী ও কয়েদীদের সঙ্গে আমদানী সেলে কাটাতে হয়। শুক্রবার সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কারা কর্তৃপক্ষের সব নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানানো হয়। নাম ঠিকানা, ছবি তুলে তাকে সাফাত ও সাদমানের সঙ্গে একই সেলে থাকবে কিনা সেটি জানতে চান একজন ডেপুটি জেলার।
তারপর নাঈম আশরাফকে সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে শাপলা ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় তাকে দেখেই ক্ষেপে যান সাফাত আহমেদ। নাঈম আশরাফের গলা চেপে ধরে ইংরেজি গালি দিয়ে (প্রকাশ অযোগ্য) চড় থাপ্পড় মারতে শুরু করে। এসময় কারারক্ষীরা এবং সাদমান দুজনকে আলাদা করে ফেলেন। এরপরও নাঈম সেখানেই থাকবে বলে কারা কর্তৃপক্ষকে জানান। কিন্তু দুজনকেই সাবধান করে দেয়া হয়েছে।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নাঈম জবানবন্দি দেয়। এ নিয়ে এ মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামির মধ্যে চার আসামিই আদালতে জবানবন্দি দিল।
মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদের বন্ধু নাঈম আশরাফ স্বীকার করে, তারা দুজন হোটেলের দুটি কক্ষে আটকে ওই দুই তরুণীকে ধর্ষণ করে। অন্য তিন আসামি তাদের সহযোগিতা করে। পরে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ না করার জন্য ওই দুই তরুণীকে ভয়ভীতি দেখানোর কথাও স্বীকার করে নাঈম।
মামলার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এর আগে অন্য তিন আসামি সাফাত, সাদমান ও বিল্লালের স্বীকারোক্তির সঙ্গে নাঈমের স্বীকারোক্তির মিল রয়েছে।
নাঈম আশরাফ সিরাজগঞ্জের ফেরিওয়ালা আমজাদ হোসেনের ছেলে। তার বিরুদ্ধে বনানীর ধর্ষণ ঘটনায় জড়িত থাকার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতারণার অভিযোগও রয়েছে। তার আসল নাম আবদুল হালিম।
এদিকে মামলার প্রধান আসামি সাফাতের বাবা দিলদার আহমেদের মালিকানাধীন আপন জুয়েলার্সের বৈধ কাগজপত্র নিয়ে গতকাল শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরে হাজির হওয়ার দিন ধার্য ছিল। তবে আপন জুয়েলার্স গতকাল হাজির না হওয়ায় এর পাঁচটি শাখায় ফের অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। অন্যদিকে মামলা নিতে দেরি করা, ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া ও ভুক্তভোগী দুই তরুণীকে হয়রানির অভিযোগে পুলিশের গাফিলতি থাকার সত্যতা যাচাই করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) আছাদুজ্জামান মিয়া তিন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে লিখিত ব্যাখ্যা চেয়েছেন। তাঁরা হলেন ডিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (ভারপ্রাপ্ত ডিসি) মানস কুমার পোদ্দার, বনানী থানার ওসি ফরমান আলী ও পরিদর্শক আবদুল মতিন।
এই তিন পুলিশ কর্মকর্তা এবং রেইনট্রি হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও মহাব্যবস্থাপককে (জিএম) ডেকে এ বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। তবে গতকাল বিকেলে হোটেলের এমডি ও জিএম কমিশনের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তাঁদের ব্যাখ্যা দিলেও পুলিশের তিন কর্মকর্তা হাজির হননি।
নাঈমের জবানবন্দির ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান জানান, সাত দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল সকাল ১১টার দিকে নাঈম আশরাফকে আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের পুলিশ পরিদর্শক ইসমত আরা এ্যামি আসামি নাঈমের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার আবেদন জানান। এরপর মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদারের খাস কামরায় তাকে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য নেওয়া হয়। সেখানে যথেষ্ট সময় দেওয়ার পর নাঈম স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দেওয়ার কথা জানায় হাকিমকে। বিকেল ৪টা পর্যন্ত হাকিম জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাঈম জবানবন্দিতে বলেছে, সাফাতের জন্মদিনে দুই তরুণীকে দাওয়াত দেওয়া হয়। সাফাত ও সাদমান তাঁদের দাওয়াত দেয়। তারা জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বনানীর রেইনট্রি হোটেলের অষ্টম তলায়। এরপর পূর্বপরিকল্পিতভাবে দুই শিক্ষার্থীকে ডেকে এনে তারা তাঁদের ধর্ষণ করে। সাফাতের ইচ্ছাতেই তারা (সাফাত ও নাঈম) দুই তরুণীকে হোটেলে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। এ জন্য দুই তরুণীকে ভয় দেখানোর পাশাপাশি শারীরিকভাবে নির্যাতনও করা হয়। নাঈম স্বীকারোক্তিতে আদালতকে আরো জানায়, সাফাতের পরিকল্পনা অনুযায়ী নাঈমই ধর্ষণের সব ব্যবস্থা করে। মামলার আসামি বাকি তিনজন সহায়তা করে। বিশেষ করে ধর্ষণের সময় সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল তাদের আশপাশেই ছিল। সাফাতের দেহরক্ষী আজাদও ওই সময় তরুণীদের ভয় দেখায়। বিল্লালকে ওই সময় ভিডিও করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ঘটনা প্রকাশ না করার জন্য দুই তরুণীকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়।
নাঈমের জবানবন্দিতে জানা গেছে, যে শিক্ষার্থী বনানী থানায় মামলা দায়ের করেছেন তাঁকে সাফাত এবং অন্যজনকে নাঈম হোটেলের পৃথক দুটি কক্ষে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। এ সময় দুই তরুণীর অন্য দুই বন্ধুকে আরেক কক্ষে আটকে রাখা হয়। ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় তাঁদের মারধরও করা হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইসমত আরা এ্যামি বলেন, সাত দিনের রিমান্ড শেষে নাঈমকে আদালতে হাজির করা হয়। জবানবন্দি শেষে নাঈমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগ এনে গত ৬ মে বনানী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন এক শিক্ষার্থী। এজাহারে বলা হয়, জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে ২৮ মার্চ সাফাত ও নাঈম দুই শিক্ষার্থীকে বনানীর কে ব্লকের ২৭ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নেয়। এরপর সাফাত ও নাঈম তাঁদের হোটেলে আটকে ধর্ষণ করে।
এদিকে গতকাল বিকেলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গঠিত তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন রেইনট্রি হোটেলের এমডি বি এ এইচ আদনান হারুন ও জিএম ফ্রাংক ফরগেট। তাঁদের সঙ্গে একজন আইনজীবীসহ আরো চারজন ছিলেন। তবে অন্যদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাঁদের দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মানবাধিকার কমিশন।
এ সময় রেইনট্রির এমডি বলেন, ‘এখানে (হোটেল) মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা ঘটলে আমরাও শাস্তি চাইছি। সব সময় আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করে যাচ্ছি। ’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কার্যালয় থেকে বের হয়ে হোটেলের এমডি বি এ এইচ আদনান হারুন বলেন, দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় তাঁদের হোটেল ধ্বংসের মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মীরা পদে পদে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। ’
তবে মানবাধিকার কমিশনের সহকারী পরিচালক ও তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব এম রবিউল ইসলাম বলেন, ‘গুলশানের ডিসি, বনানী থানার ওসি ও পরিদর্শককেও আজ (গতকাল) তলব করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা না এসে সময়ের আবেদন করেছেন। কমিশন আগামী ৪ জুন তাঁদের কমিশন কার্যালয়ে হাজিরের দিন ধার্য করেছে।’
আপন জুয়েলার্সের পাঁচ শাখায় ফের অভিয়ানের প্রস্তুতি শুল্ক গোয়েন্দার : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৈধ কাগজপত্র নিয়ে গতকাল ধার্য তারিখে শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরে যায়নি আপন জুয়েলার্স কর্তৃপক্ষ। ফলে এর পাঁচটি শাখায় ফের অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। এর আগে গত ২৩ মে শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরে তলবে উপস্থিত না থাকায় গতকাল তাদের থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
বর্ধিত সময়েও আপন জুয়েলার্স কর্তৃপক্ষ হাজির না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক ও গোয়েন্দা তদন্ত অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, গতকাল আপন জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক দিলদার আহমেদসহ সব শাখার মালিকদের বৈধ কাগজ নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরে আসার কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা আসেননি। এ কারণে শুল্ক গোয়েন্দা গুলশান-২ সুবাস্তু টাওয়ার, গুলশান-১ ডিসিসি মার্কেট সীমান্ত স্কয়ার, উত্তরা ও মৌচাকে আপন জুয়েলার্সের পাঁচটি শাখায় ফের অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব শাখায় যদি বৈধ কাগজপত্র না পাওয়া যায়, তাহলে শুল্ক গোয়েন্দা আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
এর আগে ১৪ মে গুলশানে সুবাস্তু টাওয়ারে অবস্থিত আপন জুয়েলার্সের একটি শোরুম সিলগালা করে দেয় শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। সোনা কেনাবেচায় স্বচ্ছতার অভাব থাকার অভিযোগে আপন জুয়েলার্সের শোরুমগুলোতে অভিযান চালানো হয়। অভিযানের সময় গুলশানের শোরুমটি বন্ধ পাওয়ার কারণে তা সিলগালা করে দেয় শুল্ক গোয়েন্দা।
এর আগে গত ১৭ মে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে আপন জুয়েলার্সের কর্তৃপক্ষকে তলব করা হলে তারা কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেনি।
উল্লেখ্য, বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ এনে ৬ই মে বনানী থানায় মামলা করেন নির্যাতিত এক তরুণী। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৮শে মার্চ পূর্বপরিচিত সাফাত আহমেদ তার জন্মদিনের দাওয়াত দেয় এই দুই তরুণীকে। এরপর বনানীর ‘কে’ ব্লকের ২৭ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বরে রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। হোটেলের একটি কক্ষে আটকে রেখে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মামলার বাদীকে সাফাত ও তার বান্ধবীকে নাঈম ধর্ষণ করে। এ সময় সাফাতের গাড়িচালক বিল্লালকে দিয়ে ভিডিও করানো হয়েছে বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
মামলায় আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, র‌্যাগমান গ্রুপের মালিকের ছেলে সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও গানম্যান রহমতকে আসামি করা হয়। মামলার পর পৃথক অভিযানে সকল আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ মামলায় রহমত ছাড়া চার আসামিই ১৬৪ ধারায় অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। নাঈম আশরাফ সিরাজগঞ্জের ফেরিওয়ালা আমজাদ হোসেনের ছেলে। তার বিরুদ্ধে বনানীর ধর্ষণ ঘটনায় জড়িত থাকার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতারণার অভিযোগও রয়েছে। তার প্রকৃত নাম হাসান মো. আব্দুল হালিম।

No comments:

Post a Comment